নাদিম হাসান:
খোপায় রঙিন ফুল, কোমরে বিছা আর গায়ে এমিটিশনের গহনা পরে বেশ সাজগোজ করে থাকতে দেখা যায় বেদে সম্প্রদায়ের মেয়েদের । তবে এই বাহারি সাজ আর হাসি মুখের পেছনে লুকিয়ে থাকা কষ্টের কথা হয়তো জানেনা অনেকেই।
নারায়ণগঞ্জ সেন্ট্রাল খেয়া ঘাটের পাশে তিন টি নৌকায় বসতি গেড়েছে বেদেরা। রোববার বিকেলে কথা হয় বেদে কন্যা ইতি, রিয়া ও মনির সাথে। জানালেন, নিদারুন কষ্টে কাটে তাদের জীবন। কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে তারা বেঁচে আছে।
নদীপাড়ে খেলাধুলায় মত্ত শিশুদের স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে মনি বলেন, যে টাকা রোজগার করি তা দিয়ে ঠিক মত সংসার চলে না। এক বেলা খাবারের জন্য কষ্ট করতে হয় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। প্রতিটি মুহূর্তে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে দিন কাটাতে হয় । এত কষ্টের মধ্যে বাচ্চাদের স্কুলের খরচ চালাবো কি করে।
একজন বেদে শিশু নৌকাতেই জন্মগ্রহণ করে। বেড়ে উঠে সেখানেই। নৌকাতেই বিয়ে হয় তবে বিয়ের পর আলাদা আরেকটি নৌকায় গড়ে উঠে সংসার। নদীতে প্রবল বাতাসে তাদের নৌকা হেলেদুলে টিকে থাকে। ৮/৯ ফুট নৌকার এক কোণে চুলোয় চলে রান্না-বান্না, সেখানেই খাওয়া-দাওয়া, ঘুম। বেদে শিশুদের শৈশব কাটে নদীর টেউয়ের পারতে পারতে। এ যেন এক অন্যরকম জলে ভাসা জীবন।
বহু আগে থেকে স্বামীকে আঁচলে বেধে রাখার কথা শোনা যায় বেদে সম্প্রদায়ে। কী সেই রহস্য এমন প্রশ্নের জবাবে রিয়া জানান, পুরুষ বশে রাখতে তারা শরীরে সাপের চর্বি দিয়ে তৈরি তেল ব্যবহার করে এবং স্বামীর শরীরে তা নিয়মিত মালিশ করে। বেদের বিয়ের ভিন্ন আয়োজনের কথাও জানালেন, উপার্জনের মওসুম শেষ হলে বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বেদেদের বিয়েতে আপ্যায়ন কিংবা উপহার প্রদানের কোনো নিয়ম নেই। সাধারণ বর কনে একে অপরকে পছন্দ করে বিয়ে করে। বেদেদের বিয়েতে বর কনেসহ উপস্থিত সবাইকে নৃত্যগীত করতে হয়। বাহিরাগত কেউ এলে তাকেও নাচতে হয়। এসব নাচ গান একান্তই বেদে স¤প্রদায়ের। এ সময় অবিবাহিত মেয়েরা খুব আকর্ষণীয় সাজগোজ করে। তারা আরো জানালেন, আমাদের এখানে যৌথ পরিবার নেই।
তবে বেদে সমাজে এখন অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। দিনবদলের হাওয়া তাদের সমাজে লেগেছে। বিনোদনের নতুন নতুন ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সমাজব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে তাদের জীবনের উন্নতিও হয়েছে। মোবাইল ফোনের ব্যবহার, খুপড়ি ঘরে ব্যাটারি দিয়ে সাউন্ড বক্স, টেলিভিশন ও সৌরবিদ্যুতের বাতির ব্যবহার বেদে সমাজকে আলোকিত করেছে। অথচ একসময় কুপির আলোই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। এখন বেশির ভাগ বেদে পরিবারে মোবাইল ফোন ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। মোবাইল ফোনে তারা ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক ও বিনোদনমূলক যোগাযোগ করছে।
উপার্জনের মাধ্যম জানতে চাইলে তারা জানান, এখন কেউ আর বেদেনীদের সিঙ্গা লাগায় না, দাঁতের পোকা ফালায় না। আগের মতো কেউ আর চাল, ডাল, শাক-সবজির বিনিময়ে মাছ আনতে নদীর ঘাটে যায় না।
বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা জানান, সাপ খেলা অন্যতম পেশা, কিন্তু এখনকার মানুষ আর সাপ খেলা দেখতে চায় না। তাই বেদেদের এখন আর পেট চলে না, নিরুপায় হয়ে বেদে পুরুষরা পরিবারের অভাব অনটন মেটাতে নৌকা ছেড়ে ডাঙ্গায় বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। নারীরা সারা দিন বড়শি দিয়ে মাছ ধরে ও তা পরিবারের পুরুষরা বিভিন্ন মহল্লার বাজারে ও রাস্তায় গিয়ে সে মাছ বিক্রি করে। কেউ কেউ আবার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ছোট বাচ্চাদের খেলনা ও রংবেরেং এর বেলুন বিক্রি করে সংসার চালায়।